অদ্ভুতুড়ে
- bhadurisk
- Aug 17, 2019
- 5 min read
Updated: Aug 26, 2019
রবীন কোন দিন ভূত দেখেনি বা ভূতেরা কখনো রবীনকে দেখা দেবার দরকার অনুভব করেনি। তাই রবীনের খুব দুঃখ। তার বেশির ভাগ বন্ধুই ভুত দেখে ফেলেছে। অন্তত তারা রবীনকে তাই বলেছে। সে অবশ্য বন্ধুদের কথার সত্য মিথ্যে যাচাই করতে যায়নি। ভূতদের কাছে তার অনুযোগ,কি অপরাধ সে করেছে যার জন্য তারা তাকে পরিহার করে চলেছে? তার থেকে অত ছোট পিসতুতো ভাই পিন্টুটা সেদিন রসিয়ে রসিয়ে তাকে ভূত দর্শনের কাহিনী বর্ণনা করে গেছে। এ লজ্জা সে কোথায় রাখে? নাঃ, ভূত তাকে দেখতেই হবে।তাই জনে জনে সে জিজ্ঞেস করে কোন্ জায়গায় বা কোথায় গেলে ভূতের দেখা পাওয়া যেতে পারে। সাহস তার অন্যদের থেকে একটু বেশিই বলা যেতে পারে।তাই যে যা বলছে, ভূতের দেখা পাবার জন্য সে তাই করতে রাজি হয়ে যাচ্ছে।সবাই যে সোৎসাহে তার ঔৎসুক্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে তা নয়। এই তো সেদিন,পাড়ার গেজেট খাঁদুদার কাছে জানতে গেছিল,ভূত বলে সত্যিই কিছু আছে কিনা।খাঁদুদা চোখ পাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, “ডেঁপো ছেলে,ইয়ার্কি মারছো? একটা ভূত কোথাকার।” রবীন খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে ভাবল, হয় খাঁদুদা এখনও ভূত দেখে উঠতে পারেনি,তাই ধরা পড়ে যাবার ভয়ে এড়িয়ে গেল।নয়তো,ভূতের হাতে কোন সময় পর্যুদস্ত হয়ে একটা বিজাতীয় ক্রোধ মনের মধ্যে চেপে রেখেছে।তা সে যা হোক,অযথা তাকে ভূত আখ্যা দেবার মানে কি? তবে কি সব সময় ভূত দেখার সংকল্প মনের মধ্যে পোষণ করে ভূতের লক্ষণগুলো তার মধ্যে ফুটে উঠছে?
পল্টু বলল অমাবস্যার রাতে বারোটার পর ছাদের দক্ষিণ কোণে এক পায়ে দাঁড়ালে নাকি তেনাদের দেখা পাওয়া যায়। কদিন পরেই অমাবস্যা। ঠাকুমার পাঁজিটা বার করে সে দেখে নিয়েছে। বাড়ির লোকদের লুকিয়ে চুপি চুপি সে ছাদে হাজির হল যখন,তখন রাত একটা।পল্টুর কথা মত গগন দাদুর বাড়ির দিকে ছাদের অংশটায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার মনে নেই। অবশেষে পায়ে ঝিঝি ধরার মত অবস্থা।কাকস্য পরিবেদনা! কোথায় ভূত? কোন কিছু না দেখতে পেয়ে নিচে নেমে এসে আস্তে করে শোবার ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলতেই ঘরের ভেতর থেকে ঠাকুমা ঘুম চোখে কিছু ঠাওর করতে না পেরে বলে উঠলেন, “কে রে ?” এই বয়সে ঠাকুমার ঘুম খুব পাতলা। কিন্তু ঠাকুমার কান অতি সজাগ।খুট করে কোন আওয়াজ হলেই হল। ব্যস,আর দেখতে হবে না। অমনি বলে উঠবেন, “কে রে?”।উত্তর না পেলে আরো জোরে চ্যাঁচানি।বাড়ি শুদ্ধু লোকের ঘুমের দফারফা।তাই রবীন দৌড়ে ঠাকুমার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল “আমি ঠাকুমা,আমি বাবলু।” ঠাকুমা চোখটা পিটপিট করে চেয়ে ভাল করে একবার দেখে নিয়ে বললেন, “কোথায় গেছিলি এত রাতে?” “টয়লেটে।” এই একটা শব্দ উচ্চারণ করেই রবীন সটান নিজের বিছানায়। ঠাকুমার বয়স হয়েছে। তাই রাত-বিরেতে কখন দরকার লাগে এই ভেবে রবীনের শোবার ব্যবস্থা ঠাকুমার ঘরে করা হয়েছে।ঠাকুমা যেমন রবীন অন্ত প্রাণ,রবীনও ঠাকুমাকে খুব ভালবাসে। ঠাকুমার সঙ্গেই তার যত গল্প।রবীন একবার তার ঠাকুমাকেও ভূতের ব্যাপারে প্রশ্নটা করেছিল।“রাম রাম রাম,তেনাদের নাম করতে নেই বাবলু।” ঠাকুমা এক ধমকে রবীনকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। ভূতেরা নাকি সুযোগ পেলেই মানুষের ঘাড় মটকে সটকে পড়ে।তাদের মনে করলেই তারা ঠিক খবর পেয়ে যায় আর আশপাশে সুযোগের সন্ধানে থাকে।কিন্তু রবীন বুঝতে পারে না যে মানুষের হাত,পা,কোমর প্রভৃতি থাকতে ঘাড়ের প্রতি ভূতেদের এত পক্ষপাতিত্ব কেন। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পর নিভৃতে একটু বিশ্রামের ফাঁকে অসাবধানতায় হঠাৎ তেনাদের কথা যদি কারোর মনে পড়ে যায় তাহলে ঘাড় ভঙ্গ করে তার খেসারত কেন দিতে হবে এ তার মাথায় ঢোকে না।
ভুতের ব্যাপারে তার ডেঁপোমির জন্যই হোক বা তাকে সত্যি সত্যিই ভূত ভেবে হোক,সেদিনের পর থেকে খাঁদুদা তাকে সামনে দেখতে পেলে এড়িয়েই চলে।এতে রবীন কিন্তু দমে না। ভূত দেখার সব রকম প্রচেষ্টা চলতেই থাকে।এর মধ্যে এলাকার মনুষ্য বিবর্জিত যত নির্জন অঞ্চলে বট,পেয়ারা,তেঁতুল,তাল,শেঁওড়া গাছের খোঁজ পাওয়া গেল, যেখানে ভূতেরা থাকতে ভালবাসে বলে শোনা যায়,সব জায়গায় রবীন ঢুঁ মারতে লাগল।কিন্তু ভূতেরা অদৃশ্য হয়েই রইল।শেষে রবীনের ধারনা হল যে হয়ত খাঁদুদার কথা মত সে নিজেই ভূতে পরিণত হয়েছে বলে ভূতেরা তার ঘাড় মটকানোর সাহস দেখাতে পারছে না,নয়তো ভূতের দর্শন পাবার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সে এখনও অর্জন করতে পারেনি।কিন্তু এ ভাবে তো চলতে পারে না।তার বন্ধু বান্ধব,আত্মীয় স্বজন,মায় তার থেকে বয়সে ছোট পুঁটকেগুলো ভূতাভিজ্ঞ হয়ে ঘুরে বেড়াবে আর সে ভূত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়ে সবার অনুকম্পা নিয়ে জীবন কাটাবে,এ হতে পারে না। ভুত তাকে দেখতেই হবে। এর জন্য কি করা যায়,এই তার দিন রাতের ভাবনা।
হয়ত এই ভাবেই দিনগুলো কেটে যেত। হঠাৎ একদিন স্কুল যাবার পথে আশ্চর্যভাবে দেখা হয়ে গেল নন্তু দাদুর সঙ্গে।এতদিন পরে এইভাবে এই জায়গায় রাস্তায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে,এটা সে ভাবতেই পারেনি।বেশ কয়েক বছর আগের কথা। রবীন তখন বর্ধমানে মামার বাড়ি থেকে পড়াশুনো করে। তার বাবার বদলীর চাকরী। ছেলের পড়াশুনোর ক্ষতি হবে বলে মামার বাড়িতে রবীনদের অর্থাৎ রবীন আর তার মাকে রেখে বাবা চলে গেলেন দিল্লীতে।রবীনের মামা বর্ধমানে একটা কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তাঁর তদারকিতে রবীনের পড়াশুনো যাতে ঠিক পথে এগোতে পারে,বস্তুত সেই ভরসাতেই রবীনকে মামার বাড়ি রেখে যাওয়া।ঐ সময়েই নন্তু দাদুর সঙ্গে আলাপ। নন্তু দাদু রবীনের দাদুর বন্ধু। প্রায়ই আসতেন দাদুর সঙ্গে আড্ডা দিতে। দারুন মজার লোক।এত ভাল ভাল গল্প বলতেন যে কেবল গল্প শোনার জন্য স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোন রকমে মুখে কিছু দিয়ে সে ছুটতো নন্তু দাদুর বাড়ি।মামার বাড়ি থেকে মাত্র দু মিনিটের হাঁটা পথ।ঐটুকু পথই রবীনের মনে হত যেন অনেকটা রাস্তা।ফুরোতেই চায় না। নন্তু দাদুকে বাড়িতে দেখতে না পেলে রবীনের মন খারাপ হয়ে যেত। যেদিন দেখত নন্তু দাদু ফতুয়া গায়ে বাইরের ঘরে চৌকিতে বসে আছেন,সেদিন তার খুব আনন্দ।এক গাল হাসি নিয়ে নন্তু দাদু রবীনকে ঘরে ডেকে নিয়ে বলতেন,“এসো,বাবলুবাবু এসো।আজ কি গল্প শুনবে বল।” রবীন খুশিতে ডগমগ। কখন যে দুটো ঘন্টা কেটে যেত,খেয়ালই থাকত না তার। যেন অজানা পৃথিবীর বন্ধ দরজাগুলো খুলে গিয়ে খোলা হাওয়ায় এক উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের মাঝে কেউ তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু তা হবার জো নেই।বাড়ি গিয়ে মামার কাছে বই নিয়ে বসতে হবে।
কি আনন্দেই না কেটেছিল দিনগুলো। নন্তু দাদু বলতেন “অযথা কোন কিছুতেই ভয় পেয়ো না বাবলুবাবু। যাচাই না করে অন্ধের মত কোন কিছুতে বিশ্বাস কোরো না।” নন্তু দাদুর সেই কথাগুলো যেন মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।তাইতো যখন এত লোক ভূত নিয়ে এত কথা বলে,সে মন থেকে মেনে নিতে পারে না।তার প্রমান চাই।প্রমান ছাড়া সে কোন কিছুই মেনে নিতে পারবে না।এতদিন পরে আজ নন্তু দাদুকে কাছে পেয়ে সে যেন হাতে চাঁদ পেল।নন্তু দাদু জানালেন যে কলকাতায় তিনি মেয়ের বাড়িতে এসেছিলেন।সেলিমপুরে।তার মানে রবীনদের বাড়ির খুব কাছেই। এখন আবার বর্ধমানে ফিরে যাচ্ছেন।“বাবলুবাবু কত বড় হয়ে গেছ।কেমন আছো? পড়াশুনো কেমন চলছে? বাড়ির সবাই কেমন আছে?” এক নাগাড়ে এমন হাজারতরো প্রশ্ন করে নন্তু দাদু থামলেন। রবীন তাঁকে ছাড়তে চায় না। জোর করে তাঁকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। বলে, “দাদু,তোমার আজ যাওয়া হবে না। আজ আমাদের বাড়ি থেকে কাল ফিরে যেও।” আসলে রবীনের মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। ভাবে উত্তরগুলো নিশ্চয়ই নন্তু দাদুর জানা।নন্তু দাদু পন্ডিত লোক। কত কি জানে। বছর কয়েক আগে, রবীনের দাদু মারা যাবার সময় রবীন বর্ধমানে মামার বাড়ি গিয়েছিল। তখনই নন্তু দাদুর সঙ্গে শেষ দেখা। আজ এতদিন পরে আবার নন্তু দাদুর দেখা পেয়ে সে যেন আনন্দে আত্মহারা।কিন্তু নন্তু দাদু রবীনকে বুঝিয়ে বললেন যে আজ তাঁর কলকাতায় থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে আজ ফিরতেই হবে। বরং আর একদিন এসে থাকবেন আর সেদিন সারাদিন কেবল গল্প করা যাবে।রবীন এরপর আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। তার চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল। নন্তু দাদু বিদায় নিলেন।
এর দিন পনেরো পর,একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে রবীন মার কাছে শুনল দিদিমার খুব অসুখ। মামা একবার যেতে বলেছে।বাবা অফিসের কাজ ফেলে যেতে পারবেন না বলে রবীনকেই মার সঙ্গে যেতে বলেছেন।দিদিমার অসুখের খবর পেয়ে উৎকন্ঠিত হলেও রবীন যেন একটা কথা ভেবে একটু উৎফুল্ল হল। কারণ,এই অবসরে নন্তু দাদুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।যাই হোক,মামার বাড়িতে পৌছে দেখল দিদিমা অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন। ডাক্তার সকালবেলা এসে দেখে গিয়েছেন। বলেছেন,ভয়ের কিছু নই। রবীন অনেকটা আশ্বস্ত হল। ভাবল,এই ফাঁকে একটু নন্তু দাদুর বাড়ি ঘুরে আসবে। বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে,মামা জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?” রবীন পায়ে চটিটা গলাতে গলাতে বলল, “নন্তু দাদুর সঙ্গে একটু দেখা করে আসি।” মামা গম্ভীর হয়ে বললেন, “তার আর দরকার হবে না।নন্তু কাকা গত মাসে মারা গেছেন।” রবীনের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।গলাটা যেন হঠাৎ শুকিয়ে গেছে। শূণ্য দৃষ্টিতে মামার দিকে চেয়ে বলে উঠল, “তা হলে?” মামা অবাক হয়ে বললেন, “কি তা হলে?” রবীনের গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোল না।সে তখন অন্য কথা ভাবছে। তাহলে সেদিন স্কুল যাওয়ার পথে যাঁর সঙ্গে দেখা হল,তিনি কে? তিনি কি তবে নন্তু দাদুর ……..?
Comments