আমাদের স্কুল ও কলেজ জীবনে এমন সব শিক্ষকদের সংস্পর্শে এসেছি যাদের কথা মনে হলে আজও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে শুধু নয়, তার বাইরেও ছাত্রদের ভালমন্দের কথা চিন্তা করতে,তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখা তাঁরা তাঁদের কর্তব্য মনে করতেন। অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার বহন করেও অতি সাধারন জীবনযাত্রার যে উদাহরণ তাঁরা ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতেন, ছাত্ররা তাকে আদর্শ ভেবে ভবিষ্যৎ জীবনের মাপকাঠি ঠিক করতে পারত। কঠোর শাসনই যে ছাত্রদের বশে রাখার একমাত্র উপায় নয়,ভালবাসাও যে অতি দুরন্ত ছাত্রকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে তা তাঁদের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বারবার তাঁরা প্রমান করেছেন। পড়া না পারায় মারধোর করেছেন আবার স্কুলছুটির আগে ডেকে নিয়ে গিয়ে ডাস্টার দিয়ে মারার জায়গাটায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। ক্লাসের চল্লিশটা মিনিট অপূর্ব দক্ষতায় বিষয় বিশ্লেষনে ব্যস্ত থেকেছেন,জিজ্ঞেস করে পরীক্ষা করেছেন ছাত্ররা বুঝল কি না। এর বাইরেও টিচারস রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করার স্বাধীনতা ছিল। তখন সাজেসনের জন্য মারামারি ছিল না। প্রাইভেট টিউসনের ব্যবসা ছিল না। কোচিং ক্লাস ব্যাঙের ছাতার মত গজায়নি তখন। তবু পড়াশুনো হত তখন।
মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে অথচ কোচিং ক্লাসে ভর্তি হয়নি এমন ছাত্রের সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে। কোচিং সেন্টারে না ভর্তি হলে নাকি ভাল ফল করা যায় না। কারণটা কি? কারণ স্কুলে আজকাল পড়াশুনো ঠিক মত হয় না। বেশিরভাগ শিক্ষকদের সময় নেই। হয় তাঁরা প্রাইভেট টিউসনে বেশি আগ্রহী নয়ত কোচিং ক্লাসের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন, ছাত্ররা যাতে পরীক্ষায় মার্কসের চূড়োয় উঠতে পারে। লেখাপড়া শিখে টাকার পেছনে ছোটা তখনও শুরু হয় নি। কোন কিছু ক্লাসে না বুঝতে পারলে স্যারের নির্দেশ ছিল কলেজ ছুটির পর তাঁর ঘরে গিয়ে জেনে নিতে। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। এমন অনেকদিন হয়েছে বোঝাতে গিয়ে এমন মগ্ন হয়ে গেছেন যে সময়ের খেয়াল নেই। দারোয়ান তালা চাবি নিয়ে ঘরের বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে ঘর বন্ধ করার কথা বললে তখন তাঁর হুঁশ ফিরেছে। এই শিক্ষাদানে নিবেদিত প্রাণ কোথায় এখন? ক্লাশের পড়া ঠিক মত হলে এত প্রাইভেট কোচিংয়ের দরকার পড়ে কি?
তখন যারা অধ্যয়ন শেষে শিক্ষকতা করাটাকে জীবনের ব্রত বলে বেছে নিতেন তাঁরা কখনও একে অর্থকরী বিদ্যা মনে করতেন না। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে সমাজের সেবা করাটাই লক্ষ্য ছিল তাঁদের। যে মুহূর্তে শিক্ষাকে ব্যবসার অঙ্গ হিসেবে মনে করা হয়েছে সে মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছে অবক্ষয়। মানুষ তৈরি করার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অর্থকরী সাফল্যকে বড় করে দেখা শুরু হয়েছে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে লোকের অর্থনৈতিক চাহিদারও পরিবর্তন হয়েছে। সবাই রসে বশে আরাম করে থাকবে আর শিক্ষকরা শিক্ষদানের মহান ব্রতে ব্রতী হয়েছেন বলে জীবন যাপনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণ করতে পারবেন না, এটা কখনও হতে পারে না। আমার মনে আছে, আমাদের স্কুলে প্রাইমারী বিভাগের ক্লাস টিচার আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। একটা প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর অতি সজ্জন ছাত্র অন্ত প্রাণের অবসর গ্রহণের পর কি পরিণতি হল, তা চোখের সামনে এখনো ভাসে। দারিদ্রের কষাঘাত যে কি নির্মম, তা তাঁকে দেখলে বুঝতে পারতাম। ঐ ছোট বয়সে অবাক হয়ে ভাবতাম কেন এমন হল? অথচ আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তার কোন প্রতিকারের উপায় ছিল না। আমরা কেবল বড় বড় কথা বলতে পারি, আমাদের নেতারা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে হাততালি কুড়োতে পারেন, কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার আঁতুড় ঘরের অস্বাস্থকর অবস্থার প্রতিকারে কেউ সচেষ্ট হই না। শিক্ষকের কাঁধে যদি সমাজ গড়ার দায়িত্ব থাকে তবে সরকারের বা জনগণের কাঁধেও তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা উচিত। খালি পেটে শুধু ধর্ম কেন, কোন কাজই করা যায় না।
তাই বোধ হয় অতিরিক্ত আয়ের সন্ধানে স্কুলের বাইরে অতিরিক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা তাঁরা নিজেরাই চালু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ তাঁদের আর্থিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হলেও অর্থ নামক ভয়ঙ্কর মাদকে নেশাগ্রস্তদের ফেরার আর রাস্তা নেই। অদ্ভুত সমাজ ব্যবস্থা! যখন নিদারুণ অর্থকষ্টে তাঁদের দিন কাটত তখন সমাজ নির্বিকার ছিল। আর আজ যখন শিক্ষা ব্যবস্থা এক অরাজকতায় হতদরিদ্র, শিক্ষককুল কেবল নিজেদের আর্থিক সুব্যবস্থার চিন্তায় মশগুল, সমাজ এখনও একই রকম ভাবে নির্বিকার। সবাই কেবল নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত। বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে কি ভাবে মানিয়ে নিতে হবে তার প্রশিক্ষনেই নিয়োজিত সবাই। শিক্ষার একি ছন্নছাড়া অবস্থা! পাঁচশোয় পাঁচশো কিংবা নিদেন পক্ষে চারশো নিরানব্বই তুলতে ব্যস্ত সবাই। এতো করেও যারা চারশোর গন্ডী পেরোতে পারল না, সেই সব ছাত্র-ছাত্রীদের কথা কে ভাববে? এরা কি আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় একেবারেই ব্রাত্য? তাই বা বলি কি করে? কদিন ধরে তথাকথিত মেধা তালিকায় নাম ওঠা ছাত্র-ছাত্রীদের যা দূরাবস্থা দেখছি! মেধা তালিকায় নাম আছে তো কি হয়েছে? ভর্তি হতে গেলে টাকা লাগবে। না না, কলেজ ফীর কথা বলছি না। এটা দাদাদের মনোরঞ্জন ফী। তাও আবার এক টাকা দু টাকা নয়, ষোল-সতেরো থেকে শুরু করে পঞ্চাশ-যাট হাজার টাকা! হ্যা,অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার মতই কথা। এসব খবরের কাগজেই পড়া। নিশ্চয়ই শুধু দূর্নাম রটানোর জন্য এসব খবর ছাপা হয় নি। যা রটে তার কিছুটাতো বটে। তবে এই কিছুটা যে মাত্রাছাড়াই হয়েছে তা বাতাসে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। কিছু হলেই আজকাল একটা শব্দ বহুল প্রচলিত। সেটা হল ‘বহিরাগত’। যেন বহিরাগত হলেই সাতখুন মাপ। আর বহিরাহত মানে নিশ্চয়ই অন্য রাজ্য থেকে আগত নয়। বরং বহিরাগত হয়ে কলেজে কলেজে জুলুমবাজি করলে তাদের ধরা তো সহজ। কঠোর শাস্তি বিধানে এ অরাজকতা বন্ধ করা মোটেই শক্ত নয়। এক ছাত্র বলেছে, ‘মেধা তালিকায় ’ আমার নাম আছে। আমি ভর্তি হতে পারবো না কেন? কেন আমায় টাকা দিতে হবে? সপাটে উত্তর এল, ‘ব্রাজিলের টিমে আমার নাম উঠেছিল। তাহলে বিশ্ব কাপে আমায় নেওয়া হল না কেন?’ এখানে বক্তার রসিকতা করার স্পর্ধা দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। কতটা দুঃসাহসী ও শাসন ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাবার প্রবণতা থাকলে এই রকম দুর্বিনীত হওয়া যায়! ঘটি বাটি বেচে কিছু টাকা সংগ্রহ করে যে ছেলেটা পারিবারিক দুঃখ কষ্টকে দিনের পর দিন সহ্য করে ভবিষ্যতটাকে একটুখানি আলোময় করতে কলেজে ভর্তি হতে ছুটে এসেছে, তার কি এটাই প্রাপ্য ছিল? মেধা তালিকায় নাম থাকবে. তা সত্ত্বেও পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে- এ ঘটনা এই প্রথম দেখছি। এতদিন শুনেছি ভাল কলেজে ভর্তি হতে গেলে নম্বর বেশি পেতে হবে। তা না পেলে অন্য কলেজে ভর্তি হতে হবে। এর অন্যথা করতে কেউ কেউ কখনও কখনও অন্য উপায়ের ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট হত। এটাই এতদিন জানা ছিল। কিন্তু পড়াশুনা করেও, ভাল নম্বর পেয়েও দাদাদের করুণাপ্রার্থী হয়ে থাকতে হবে, এ ঘটনা বোধ হয় সবার চোখ খুলে দিল। আমরা সবাই কত অসহায়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
টিভিতে সেদিন একটা সিরিয়াল দেখছিলাম। ঠাকুর্দা নাতিকে ঠাকুমার ঝুলির গল্প শোনাচ্ছেন। শুনতে শুনতে নাতির হঠাৎ প্রশ্ন “আচ্ছা দাদু, ঠাকুমা এখন কোথায়?” নাতি জানে ঠাকুমা আর ইহলোকে নেই। কিন্তু পরলোকে গেলেও,সেটা কোথায়? নাকি ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির দেশে রাজকন্যে হয়ে রাক্ষসের প্রাসাদে বন্দিনী হয়ে আছে। দাদুর কাছে গল্প শুনে শুনে ঐ বয়সে তার কল্পনা শক্তি আকাশের কোণে কোণে খুঁজে বেড়ায় তার ঠাকুমাকে। দাদু বলেছে তার ঠাকুমা আকাশে তারা হয়ে জ্বলছে। নাতি দাদুকে ধরেছে রাত্রিবেলা তারাটাকে চিনিয়ে দিতে হবে। এমন সময় ছেলেটার মার ঘরে প্রবেশ। শ্বশুরকে রীতিমত বকুনি। “বাবা,আপনি ওর মাথাটা খাচ্ছেন।এখন অন্য যুগ। ওসব আষাঢ়ে গল্প বাচ্চাদের বুদ্ধির প্রকাশ হতে দেয় না। এখন বাস্তবতার যুগ। প্রতি স্টেজে প্রতিযোগিতা,হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এখন কি ঐ অবাস্তবতায় মোড়া গল্প শুনে বড় হওয়া উচিত?” বুড়ো শ্বশুর চোখ বড় বড় করে বৌমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ক্ষীণস্বরে বলবার চেষ্টা করেন, “সে কি বৌমা ! এ গল্প শুনলে বুদ্ধির বিকার ঘটবে? পড়াশুনো হবে না? আমরাও তো ছোটবেলা আমাদের দাদু-দিদিমার কাছে এই গল্প শুনেই বড় হয়েছি। আমাদের কি পড়াশুনো হয়নি? আমরা কি চাকরি-বাকরি করিনি? তোমার স্বামীটি যে বড় চাকুরে হয়েছে,সেও কি ঠাকুমার ঝুলি পড়ে বড় হয় নি?”
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, Imagination is the mother of creation. আইনস্টাইনের মত বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক বলেন, Imagination is more important than knowledge. বিশ্বের তাবড় তাবড় শিশু মনোবিদ ও শিশু শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মত হল কল্পনাশক্তির বিকাশের মধ্য দিয়েই শিশুর সৃষ্টিশীলতা,স্বকীয়তা ও চিন্তাশক্তির স্বাধীনতা প্রকাশ পায় এবং সে ভবিষ্যতে বাঁধা গৎয়ের বাইরে গিয়ে জগতকে চেনা ও সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করে। মানুষের মন বলে একটা সম্পদ আছে যেটা একেবারেই তার নিজস্ব।সেখানে বাইরের খবরদারি চলে না। মনের বিচরণ সব ক্ষেত্রে বাধামুক্ত,বিদ্যুতের গতিতে আর সেই মনের সর্বব্যাপী সাম্রাজ্যে মুক্ত বিচরণের বাহন হল কল্পনা শক্তি। আমরা যদি শিশু বয়স থেকেই সেই কল্পনার ডানাটাকে কেটে দিই তাহলে তার বা তার পরিবারের কিংবা সামগ্রিক ভাবে সমাজের কি ঘোড়ার ডিম উন্নতি হবে বা হচ্ছে তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
সত্যি বলতে কি ,আজ এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। জীবনটা ছোটবেলা থেকেই কঠিন বাস্তবতায় মোড়া ডানাকাটা পাখীর মত বেড়ে উঠছে। এ পাখী উড়তে পারেনা। এ পাখীর মনের স্বাধীনতা নেই। কবিগুরুর তোতাপাখীর মত পেট ভর্তি শুধু কাগজের খসখস। ছোটবেলা থেকেই তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে রণক্ষেত্রে। এক একটা চেঙ্গিজ খাঁ হয়ে উঠে দিগ্বিজয় করার জন্য। প্রতিটা যুদ্ধ জিততে হবে। সবেতে ফার্স্ট হতে হবে। ক্রিকেট খেলতে হবে বিরাটের মত,ফুটবলে মেসি। যোগ ব্যায়াম শিখতে হবে, সারাদিনে পাঁচটা কোচিং ক্লাসে হাজিরা দিতে হবে, নাচে বিরজু মহারাজ, গানে লতা মুঙ্গেশকর হতে হবে। মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে এ পৃথিবীতে হেরোদের কোন জায়গা নেই। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। অনেক দিন আগের কথা। তখন আমি আগরতলায়। দুর্গাপূজোর কদিন আগে। অফিস বেরোতে যাবো,হঠাৎ দরজায় কারা যেন কড়া নাড়ল। বেরিয়ে আসতে দেখি গুটিকয় ছেলে,বয়স পনেরো থেকে কুড়ি। হাতে চাঁদার বিল। একজন বিলটা কাটছে আর একজন জানিয়ে দিল যে গতবার তারা ফোর্থ হয়েছিল।এবার ফার্স্ট হতে চায়,তাই চাঁদার অঙ্কটাও একটু বেশি। মাত্র দুশো টাকা। গতকালও একদল এসেছিল। তারাও গতবারের থার্ড পজিসন থেকে এবার ফার্স্ট হতে চায়। অর্থদন্ড মাত্র একশো টাকা। জানিনা এইভাবে গতবারের দশম স্থানাধিকারী পর্যন্ত আসবে কিনা। আমি যতটা পারা যায় অটল থাকার চেষ্টা করে বলে উঠলাম, “ভাই , আমি দেখছি সবাই ফার্স্ট হতে চাইছে। কিন্তু সেটা তো হবে একজন ।আমি কেন মাঝখান থেকে সবাইকে ফার্স্ট করতে যাবো?” কথাটা ওদের পছন্দ হল না। বিলটা বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেল।
এই ফার্স্ট হওয়ার প্রতিযোগিতাটাই সমাজকে একেবারে অসহিষ্ণু করে তুলেছে। বাবা-মা দেখছে না তাদের সন্তান কি চায়, তাদের ক্ষমতা কতটুকু। স্বাভাবিক অগ্রগতির রাস্তায় না গিয়ে আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশার ভার সন্তানের কাঁধে চাপিয়ে তারা স্বপ্ন দেখছে। আর তাদের স্বপ্নভঙ্গের দায়ভার বহন করতে না পেরে অভাগা সন্তানের হতাশা আকাশ বাতাস ভারি করে তুলছে। এটাই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বাতাবরণ। সে সময় বাংলা মিডিয়মে পড়াশুনো করার মধ্যে কোন হীনমন্যতা ছিল না। তা হলেও দু কলম ইংরেজি লেখার ক্ষমতা প্রায় সবারই ছিল। এখন ইংরেজি মিডিয়ম না হলে সমাজে ব্রাত্য। হ্যা,ফটাং ফটাং ইংরেজি বাক্যের স্বতস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস দেখা যায় বটে, তাতে জ্ঞানের ভান্ডার ভরে ওঠে বলে মনে হয় না। বেশিরভাগ সরকারি স্কুল বাংলা মাধ্যমের। দুশো বছরের পরাধীনতার শোধ তুলতে ইংরাজিটাই প্রাথমিকে তুলে দেওয়া হল। জ্ঞানী ব্যক্তিরা ভাবলেন, এই বেশ হল। একদিকে ইংরেজ ও ইংরাজির ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার বাহ্যিক আড়ম্বর দেখানো গেল আর সেই সঙ্গে মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্রাপ্তিতে শিক্ষার ধ্বজা আরও উঁচুতে এবার পতপত করে ওড়ার ব্যবস্থা করা গেল। কিন্তু কাজে তা হল কই? প্রয়োজন মত ইংরাজির জ্ঞান না থাকায় সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতাগুলোতে আমাদের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়তে লাগল। কর্তা ব্যক্তিরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন বটে, কিন্তু অনেক দেরিতে। গঙ্গাজলে একটু আচমন করার মত কৃতকর্মের ভুল স্বীকার করেই তাঁরা ক্ষান্তি দিলেন। এরকম কত ভুল যে রোজ হচ্ছে আর নৈবেদ্যে ফুল ছড়ানোর মত জনগণকে ভুল স্বীকারের নির্লজ্জ বাক্যবাণে সিক্ত করে তাঁরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। ক্ষতি যাদের হবার তারা রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলি হয়েই যাচ্ছে। কেন সরকারি স্কুলগুলোতেও ইংরাজি মাধ্যম করা যাবে না? তাহলে তো অন্তত প্রাইভেট স্কুলগুলোর অবিশ্বাস্য বেশি ফীর হাত থেকে ইংরাজি মাধ্যমে ভর্তি হতে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের ও তাদের অভিভাবকদের রেহাই পাবার একটা ব্যবস্থা করা যেত। সরকারি স্কুলগুলোও দ্রুত ভোল পাল্টে প্রতিযোগিতার বাজারে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারত।
স্কুলে এখন যেমন সারাদিন ধরে পড়ে যাওয়া, খেলাধুলার পাট নেই। কেবল হোমটাস্ক, প্রাইভেট টিউসন একটার পর একটা। সময় নেই বাচ্চাদের। কখন খেলবে? আর তাছাড়া ফ্ল্যাট কালচারে স্কুল আর টিউসন যাওয়া ছাড়া মাটির সাথে সংশ্রব কই? আকাশ কংক্রিটের আড়ালে ঢাকা। সবুজ ও নীল, দুই রঙের সাথেই আড়ি। পরীক্ষায় বেশি নম্বর না পেলে বাবা-মার কি রাগ! ছেলে কেন ফার্স্ট হল না। কাজেই আরও প্রাইভেট টিচার, বাচ্চার দম ফেলার সময় নেই। এরপর আছে টিভি,কম্প্যুটার, ফেসবুক,হোয়াট্সঅ্যাপ আরও কত কি! চোখের আর শান্তি হল কই? কল্পনায় পাখা মেলে ওড়বার সময়ই তো নেই। এখন পড়াশুনো মানে কেবল আর্নিং। যেন তেন প্রকারেণ, ছলে,বলে,কৌশলে শুধু লড়ে যাও। ভাল নম্বর মানে ভাল কলেজ, ভাল কলেজ আবার ধারে কাটে। তারপর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সিকে ছিঁড়লে আর পেছনে তাকান নেই। অর্থ আরও অর্থ মানে আরও আর্নিং। লার্নিং কোথায়? অভিভাবকরা খুঁজে বেড়াচ্ছে কোন মাস্টারের কোচিং ক্লাসে পড়লে বেশি নম্বর পাওয়া যায়, কোন কোচিং সেন্টারে পড়লে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উতরে যাওয়া যায়। ভাল চাকরী,ভাল মাইনে। উন্নত লাইফ স্টাইল। ক্লাব, কন্টিনেন্ট ট্যুর,কন্টিনেন্টাল ডিস, ব্র্যান্ডেড পোশাক। ব্যস, জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংজ্ঞাই এখন এই। এর পেছনেই ছুটে চলেছে সবাই। ছোটবেলায় কোন বয়োজেষ্ঠ্যকে প্রণাম করলে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতেন মানুষের মত মানুষ হও। এখন আশীর্বাদ করলে বলতে হয়, জীবনের উচ্চাশা পূর্ণ হোক।
এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা দেখুন। ছাত্র রাজনীতি আগেও ছিল। কিন্তু শিক্ষক ছাত্র সম্পর্কটা এত তেতো হয়ে যায়নি। এক্ষেত্রে কেবল ছাত্রদের দোষ দেওয়া যায় না। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাই সমাজের প্রতিটি স্তরেই পারস্পরিক সুসম্পর্কের পরিপন্থী। বেশিরভাগ স্কুলে বা কলেজে নিয়মানুবর্তীতার পাটাপাট নেই। ওই যে বললাম, শিক্ষকরা প্রাইভেট ট্যুইসনে ব্যস্ত। স্কুলে বা কলেজে পড়াশুনো খুব একটা হয় বলে মনে হয় না। ছাত্ররা ছুটছে কোচিং সেন্টারে। দেখছে কোথাকার সাজেসন পরীক্ষায় মিলে যায়। কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে বিরাট প্রতিযোগিতা। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ। বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম,দ্বিতীয় স্থানাধিকারীদের নিয়ে কাগজে বড় বড় বিজ্ঞাপন। এ বলে আমার কোচিংএ পড়ে এত ভাল রেজাল্ট করেছে, ও বলে এরা আমার কোচিং সেন্টারের প্রডাক্ট। জীবন শুরুর প্রথম লগ্ন থেকেই এদের বিজ্ঞাপনের সামগ্রী বানিয়ে দিচ্ছে। এই সব ছাত্রদের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হচ্ছে, সিদ্ধিলাভের জন্য এই বই পড়ুন, ওই বই পড়ুন। চিন্তা করুন, কেরিয়ারের গোড়াতেই এরা পণ্যে পরিণত হচ্ছে। আর বিশ্বাস করুন, ঐ বই পড়ে কোনদিনই কেউ ফার্স্ট হতে পারবে না। ফার্স্ট হবার জন্য অন্য মেটিরিয়ালের প্রয়োজন। তবে হ্যা, পাশ করার জন্য প্রয়োজন হলেও হতে পারে। অথচ জেনে শুনেও মিথ্যা কথা প্রচার করা হচ্ছে বানিজ্যিক প্রয়োজনে। আর বলছে কে? একজন কৃতি ছাত্র! হয়ত সামান্য কিছু অর্থের লোভে।
কলেজে প্রয়োজন মত ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই। মুড়ি মুড়কির মত প্রাইভেট ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ খুলে যাচ্ছে। এটা এখন একটা ব্যবসা। চলছে সাদা কালোর খেলা। এই সব কলেজে ছাত্র চাই তো। তাই ছাত্রের জোগান দিতে জয়েন্ট পরীক্ষায় পাশের সীমা ফি বছর বেড়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার! এ এক ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের উল্টো থিয়োরী। জয়েন্টে ১০০০ স্থান পেয়ে যে ছেলেটা ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করল সেও ইঞ্জিনীয়ার আবার ৮০০০০ স্থান পেয়ে ঐসব ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে পড়ে যে পাশ করল, সেও ইঞ্জিনীয়ার। ডিগ্রীটা থাকলেই হল। কি জানল সেটা বড় কথা নয়। তারা দেখছে ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ডিগ্রীটা থাকলে আর ক্যাম্পাস ইনটারভিউয়ে শিকে ছিঁড়লে,তারপর মুড়ি মুড়কি এক দর।শুরু হবে থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোর।তাতে কি? মাস গেলে হাতে পয়সা। বাড়িতে দেবার ব্যাপার নেই। পয়সা খরচ করার ফিকির খোঁজো।লাইফ স্টাইলটাই চেঞ্জ করে ফেল। এটাই তো বাবা-মা চেয়েছিল। তারা জানে ছেলে আইনস্টাইন হবে না। কিন্তু হয়ত বড় সাহিত্যিক হতে পারত। হতে পারত বড় ফুটবলার কিংবা বড় গায়ক। কিন্তু নাঃ। ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার হতে হবে।হলে চাকরির চান্স বেশি। তাই দাও চাপিয়ে দাও। অত পয়সা খরচ করে চার বছর নষ্ট করে ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করল। তারপর কিনা ম্যানেজমেন্ট পড়তে চলে গেল। কেন? না পাশ করলেই মোটা মাইনের চাকরি। নিদেন পক্ষে ব্যাঙ্কের চাকরি আটকায় কে? এর মধ্যে কিন্তু খারাপ কিছু নেই। সবাই তো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেই চায়। আসলে সবার চাই অর্থকরী প্রতিষ্ঠা। এটাই এখন চাহিদা। রাস্তাটা কেবল বেশি আঁকাবাঁকা। শিক্ষা শিক্ষা বলে তাই চেঁচিয়ে কোন লাভ নেই।
কিন্তু জীবনে অর্থের প্রয়োজন অস্বীকার করবে কে? একটু স্বাচ্ছন্দ, একটু ভাল থাকা, এ তো সবার কাম্য। এতে অন্যায় কোথায়? নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। কথাটা হচ্ছে ভাল থাকা দিয়ে শুরু হয়। তারপর শুরু অন্যের তুলনায় ভাল থাকা, শেষে সবার থেকে ভাল থাকা। প্রথমে পাসেঞ্জার ট্রেন, তারপর এক্সপ্রেস, মেল। কখন যে বুলেট ট্রেনে উঠে পড়েছে সে খেয়াল থাকে না। যেন চারপাশে ধ্বনিত হচ্ছে একটাই কথা ‘কেবল আমি খাব’। অর্থের নেশা যেন সিগারেটের নেশা। আমার এক বন্ধু চেন্স স্মোকার। শেষে শরীরের এমন অবস্থা হল যে ডাক্তার সিগারেট একেবারেই বন্ধ করে দিতে বললেন। বললেন, “ প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে আর সিগারেট খাবেন না। নইলে গুরুতর সমসা হতে পারে।” বন্ধু বলে, “ডাক্তার বাবু, তাহলে তো আমি এমনিই মরে যাব।” “ হ্যা যাবেন, তবে প্রতিজ্ঞা পালন করতে গিয়ে বীরের মত মৃত্যু বরণ করবেন।” ডাক্তার ঠাট্টার ছলে বললেন। মুখটা কাঁচুমাচু করে বন্ধুবর ফিরে এলেন ডাক্তারখানা থেকে। কয়েক দিন খুব অস্বস্তি বোধ করার পর তার মনে হল ডাক্তাররা সব সময় একটু বেশি সাবধানী। সারাদিনে একটা করে সিগারেট খেলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? শুরু করলেন দিনে একটা করে খাওয়া। কদিন পর দুটো। তারপর কখন যে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছেন খেয়ালই নেই তার। অর্থের মোহ ঠিক এই রকম। একটু একটু করে মানুষকে গ্রাস করে। মানুষের ধর্মই এই। আর এখানেই লার্নিংএর গুরুত্ব! বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরীর একটা গান শুনেছিলাম। ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও। আমি নেমে যাব। এ গাড়ি যাবে না, আমি অন্য গাড়িতে যাব। এই রোকো,রোকো।’ লার্নিং না থাকলে পৃথিবীর গাড়ি থামিয়ে অন্য গাড়িতে যাবার মানসিক তাগিদও তৈরি হয় না। সমাজে একে অপরকে ডিঙিয়ে যাবার প্রচেষ্টায় যে নৈরাজ্য তৈরি হয় তা সুস্থ সমাজ গড়ার বিপক্ষে কাজ করে যায়। হয়ত অর্থ আসে কিন্তু মানসিক শান্তির বিনিময়ে। প্রতিষ্ঠা আসে কিন্তু ঈর্ষা আর অস্বচ্ছতার বিনিময়ে। আর্নিং আর লার্নিং কি সুন্দর দুটো শব্দ। কিন্তু ফারাক একটা বর্ণের, সেটা হল ‘এল’। এই একটা বর্ণই, শব্দ দুটোর আকাশ পাতাল পার্থক্য গড়ে দেয়। ‘এল’ মানে লিসনিং (Listening)। জীবনে যে কোন ক্ষেত্রে listening এর গুরুত্ব অপরিসীম। কার্য,কারণ ও পরিণাম এই তিনটে জাগতিক ক্রিয়াকলাপ সম্মন্ধিত জ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ হয় listening থেকে। শ্রুত, দৃষ্ট বা পঠিত জ্ঞানকে মনের মধ্যে উপলব্ধি করাটাই লার্নিং এর প্রধান মন্ত্র। লার্নিংএর অর্থ শুধু মাত্র কোন জিনিষ জানা বা শোনা নয় , সেই জানা বা শোনাকে জীবনের চলার পথে পাথেয় করে নেওয়া। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ উপন্যাসে অন্ধ সুরদাস জিজ্ঞেস করে ‘বাবুজী আপকা রাস্তা ঠিক হ্যায় ?’ লার্নিং-এর সার্থকতা তখনই যখন মানুষের এই ঠিক রাস্তার অনুভূতিটা বজায় থাকে। ‘কোই নহি বাতা সকতা কিধর গয়ী সড়ক, কঁহা গয়া রাস্তা। হ্যায় না বাবুজী?’ সুরদাস অন্ধ। তার জীবনের চাওয়া পাওয়ার খাতায় কত বড় শূণ্যতা! তবু ঠিক রাস্তা খোঁজায় সে দিন কাটিয়ে দেয়।
Comments